নেত্রকোনার রোয়াইলবাড়ি দুর্গ এখন ইতিহাস

প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৫ সময়ঃ ৩:১৬ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৩:১৮ অপরাহ্ণ

ডেস্ক রিপোর্ট, প্রতিক্ষণ ডটকম:

roailmari‘রোয়াইল’ আরবি শব্দ। এর অর্থ ‘ক্ষুদ্র অশ্বারোহী বাহিনী’। সুতরাং ‘রোয়াইলবাড়ি’ শব্দটির মূল অর্থ হলো ‘অশ্বারোহী বাহিনীর বাড়ি’।

নাম দেখেই বোঝা যায় জায়গাটির সঙ্গে বাংলার ইতিহাসের একটি সম্পর্ক আছে। প্রাচীণ শাসনকর্তাদের অশ্বারোহী বাহিনীর ঠক্ ঠক্ শব্দে দিনের পর দিন কেঁপেছে এই এলাকার মাটি। তারা আজ আর নেই।

কিন্তু তাদের কীর্তির সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীণ এই দুর্গ। যদিও হারিয়ে গেছে এর আগের রূপ-অবয়ব। রোয়াইলবাড়ি এখন কেবলই এক নীরব, নিথর ধ্বংসস্তুপ।

ঐতিহাসিকদের মতে, সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ্ ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে কামরূপের রাজা নিলাম্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে কামরূপ রাজ্য দখল করেন। এরপর তার পুত্র নছরৎ শাহ্ কামরূপ শাসন করেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই প্রতিপক্ষের আক্রমণের মুখে তিনি বিতাড়িত হন এবং এক পর্যায়ে কামরূপ থেকে পালিয়ে আসেন।

কথিত আছে, নছরৎ শাহ্ কামরূপ থেকে পালিয়ে এসে পূর্ব ময়মনসিংহের (বর্তমান নেত্রকোনার) রোয়াইলবাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি এ অঞ্চলটির নামকরণ করেন ‘নছরৎ ও জিয়াল’। পরবর্তীতে তার শাসনাধীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ ‘নছরৎশাহী পরগণা’ নামে পরিচিত হয়।

এরপর ঈশা খাঁ এ অঞ্চলে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি ও নেত্রকোনার রোয়াইলবাড়ি দুর্গের নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে নেন। জানা গেছে, রোয়াইলবাড়ি থেকে জঙ্গলবাড়ি পর্যন্ত যাতায়াতের একটি রাস্তা ছিল, যা এখন পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ঈশা খাঁর মৃত্যুর পর তার পারিষদ দেওয়ান জালাল এখানকার আধিপত্য গ্রহণ করেন। তিনি রোয়াইলবাড়ি দুর্গের সংস্কার করে দুর্গের বহিরাঙ্গনে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এটি ‘মসজিদ-এ-জালাল’ নামে পরিচিত ছিল।

index১এসবই পুরনো দিনের কথা। এর অধিকাংশই হয়তো জানা যেত না যদি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এখানে খনন কাজ পরিচালনা না করতো। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় রোয়াইলবাড়ি দুর্গে খনন করে বিভিন্ন ধরনের প্রাচীণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়।

উদ্ধার করা হয় ইটের দেয়ালবেষ্টিত দুর্গ, মূল প্রবেশদ্বার (সিংহদ্বার), বহু কক্ষবিশিষ্ট একাধিক ইমারতের চিহ্ন, সান বাঁধানো ঘাটসহ দুটি বড় পুকুর, দুটি পরিখা, বুরুজ ঢিবি, লতাপাতা ও ফুল-ফলে আঁকা রঙিন প্রলেপযুক্ত কারুকাজ, পোড়ামাটির অলংকৃত ইট, বর্শা, লোহা ও চিনামাটির নানা জিনিসপত্র।

সমস্ত দুর্গ এলাকা তিনভাগে বিভক্ত। মূল দুর্গের পূর্বদিকে ছিল দু’টি পুকুর, যা এখনও আছে। দক্ষিণ দিকের মাটির দেয়ালের দুই পাশে ছিল দুটি পরিখা। একটি পরিখা বেতাই নদী থেকে আসা নৌযানসমূহ নোঙ্গর করার জন্য ব্যবহৃত হতো বলে অনুমান করা হয়। ধারণা করা হয়, দুর্গের উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে বড় বড় পাথর খণ্ড দিয়ে নির্মিত আরও দুটি প্রবেশ পথ ছিল।

খননের সময় পর্যন্ত দুর্গের অভ্যন্তরের উত্তর ও পূর্বদিকের প্রবেশ দেয়াল দুটি সাদা, নীল, সবুজ ও বাদামি রংয়ের চকচকে টালি দিয়ে বিভিন্ন ফুল-ফল, লতাপাতার নকশায় সজ্জিত ছিল। এখন এগুলো শেওলায় ঢেকে গেছে। খননের পর এখানে যে মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়; ধারণা করা হয়-এটিই দেওয়ান জালাল নির্মিত ‘মসজিদ-এ জালাল’।

জানা যায়, এই মসজিদের ১৫টি গম্বুজ ছিল। এছাড়া মসজিদের কাঠামোতে ছিল ১২টি দরজা, পাঁচটি খুতবা পাঠের মেহরাব এবং মার্বেল পাথরের তৈরি বিশাল কয়েকটি খিলান। চমৎকার সূর্যমূখী ফুলের নকশায় পরিপূর্ণ ছিল মসজিদের দেয়াল। গবেষকদের মতে, রোয়াইলবাড়ি দুর্গের সমস্ত স্থাপনা সুলতানী আমলের স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত হলেও এর কারুকাজ ছিল অনেক বেশি নান্দনিক ও শিল্পসমৃদ্ধ।

প্রতিক্ষণ/এডি/রানা

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য



আর্কাইভ

April 2024
S S M T W T F
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930  
20G